International Women's Day 2025: ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে ক্যানসারগুলি দেখা যায়, তার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানেই সার্ভিকাল ক্যানসার। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ৫ শতাংশ মহিলা এই ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আর ক্যানসারটির নেপথ্যে থাকে হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস বা এইচিপিভি (HPV)। যৌন সংক্রমণের কারণে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য রোগের মতোই। ২০২৪ সালে ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে এইচিপিভি টিকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তবে এইচিপিভি সংক্রমণ শুধু যে মহিলাদের হয়, তা কিন্তু নয়। আবার এই সংক্রমণে শুধু যে সার্ভিকাল ক্যানসার হয়, তাও নয়। নারী দিবস উপলক্ষে এইচিপিভি সংক্রমণজনিত ক্যানসার ও ভাইরাসটির টিকা নিয়েHT বাংলার সঙ্গে কথা বললেনচিকিৎসক পর্ণমিতা ভট্টাচার্য (গাইনিকোলজিস্ট, সিকে বিড়লা হাসপাতাল) ওচিকিৎসকসুজাতা দত্ত (গাইনিকোলজিস্ট, ফর্টিস হাসপাতাল)।
মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষরাও বিপদে
‘হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের ১০০-র বেশি স্ট্রেন (বা রূপ) রয়েছে। এর মধ্যে কিছু স্ট্রেন থেকে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’ এগুলিকে হাই রিস্ক স্ট্রেন বলে উল্লেখ করলেন পর্ণমিতা। তাঁর কথায়, ‘অন্য স্ট্রেনগুলি লো রিস্ক। অর্থাৎ এগুলির থেকে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি না থাকলেও ইনফেকশন হতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার, এইচিপিভি যৌন সংক্রমণের মাধ্যমে ছড়ায়। যৌন সঙ্গম (ইন্টারকোর্স) না হলেও যৌনাঙ্গের স্পর্শের মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে। অন্যদিকে ব্যারিয়ার মেথড অর্থাৎ কন্ডোমের মতো সুরক্ষিত বিকল্প ব্যবহার করলেও এইচপিভি সংক্রমণ সবসময় আটকানো সম্ভব নয়।’ এই ভাইরাসের কারণে মহিলাদের পাশাপাশি ছেলেদেরও ক্যানসার হতে পারে।
কী কী ক্যানসারের ঝুঁকি?
এইচিপিভি থেকে শুধু যে একরকম ক্যানসার হয় না, সে কথাও স্পষ্ট করে দিলেন চিকিৎসক। পর্ণমিতার কথায়, ‘এই ভাইরাসের কারণে সার্ভিকাল ক্যানসার ছাড়াও ভালভার ক্যানসার, ভ্যাজিনাল ক্যানসার, অ্যানাল (মলদ্বার) ক্যানসার, ওরোফ্যারিঞ্জিয়াল (গলা ও মুখ) ক্যানসার হতে পারে। অন্যদিকে ছেলেদের পেনাইল (লিঙ্গ) ক্যানসার, অ্যানাল ক্যানসার, ওরোফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে এইচিপিভি থেকে।’ ফলে ছেলে বা মেয়ে কেউই নিরাপদ নন এর ঝুঁকি থেকে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ভূমিকা
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘সক্রিয় যৌনজীবন (সেক্সুয়ালি অ্যাক্টিভ) রয়েছে এমন যে কোনও ব্যক্তি এই ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইমিউনিটি এই ভাইরাসকে মেরে ফেলে। ফলে ২-১ বছর পরে শরীর থেকে সংক্রমণ বিদায় নেয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পেরে ওঠে না স্ট্রেনের সঙ্গে। ইমিউনিটি দুর্বল হলে এমনটা হতেই পারে। তখন দীর্ঘদিন ধরে শরীরে রয়ে যায় স্ট্রেনগুলি। ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে।’
হাই রিস্ক স্ট্রেন
‘এইচপিভি-র হাই রিস্ক স্ট্রেনগুলির মধ্যে অন্যতম হল এইচপিভি ৬,এইচপিভি ১১, এইচপিভি ১৬ ও এইচপিভি ১৮। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেকসময় এগুলোর সঙ্গে পেরে ওঠে না। তখন শরীরে থাকতে থাকতে এই ভাইরাস থেকে ক্যানসার জন্ম নেয়। বিশেষত সার্ভিক্স বা জরায়ুমুখে ভাইরাসগুলি কোশে একধরনের বদল আনে। একে প্রিক্যানসারাস স্টেজ বলা হয়।’
উপসর্গ নেই বলেই ভয়
এইচপিভি সংক্রমণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনিটাল ওয়ার্টের (যৌনাঙ্গে ছোট ছোট ব্যথাহীন মাংসল ফোঁড়া) মতো উপসর্গ দেখা যায়। তবে পর্ণমিতার কথায়, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনও উপসর্গ দেখা যায় না। ফলে অনেকেই বুঝতে পারেন না তিনি আক্রান্ত।’ সংক্রমণ মূলত দুই ধরনের হয় বলে জানালেন চিকিৎসক। ‘প্রথম ক্ষেত্রে শরীর নিজেই সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসকে মেরে ফেলে। অন্য ক্ষেত্রে মারতে পারে না। ফলে ক্যানসারের দিকে ধীরে ধীরে এগোয় সংক্রমণ।’
এইচপিভি প্রতিরোধের উপায়
চিকিৎসক সুজাতা দত্ত এই প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিলেন—
১. এইচপিভি প্রতিরোধ করতে হলে এর কারণগুলিকে আটকাতে হবে। কন্ডোম থাকলেও এইচপিভি হতে পারে। তবুও অসুরক্ষিত যৌনমিলন এড়িয়ে চলতে হবে।
২. একাধিক সঙ্গী থাকলে এইচপিভিজনিত সংক্রমণ ও ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাই এই ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।
৩. বর্তমানে এইচপিভি প্রতিরোধের জন্য টিকা এসে গিয়েছে বাজারে। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সকলেরই এই টিকা নেওয়া উচিত। টিকা একবার নিয়ে নিলে শরীরে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। ফলে ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। টিকা নেওয়ার ব্যাপারে মানতে হবে কিছু নিয়ম। সেই নিয়মগুলিও বিশদে জানালেন সুজাতা।
এইচিপিভি টিকা নেওয়ার নিয়ম
প্রথম যৌনমিলনের আগে এইচিপিভি টিকা নিয়ে নেওয়া উচিত। তাই ১২-১৪ বছর বয়সে টিকা নেওয়ার কথা বলা হয়ে থাকে। সুজাতার কথায়, ‘টিকা নেওয়ার সেরা সময় ১২-২৫ বছর। ৪৫ বছর পর্যন্ত নেওয়া যায়। কিন্তু ১২-২৫ বছরের মধ্যে নিলে সবচেয়ে কার্যকরী হয়।’
ক’টা ডোজের টিকা?
‘১৪ বছরের আগে নিলে দুটো ডোজই যথেষ্ট। ১৪ বছরের পরে নিতে হলে তিনটে ডোজ নিতে হয়। দ্বিতীয়টি প্রথম ডোজ নেওয়ার দুমাস বাদে, তৃতীয়টি ছয় মাস বাদে।’ পাশাপাশি সুজাতা জানালেন, ‘এই টিকার কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সেভাবে নেই। বিদেশে প্রায় ২০-২৫ বছর আগে থেকে টিকাটি চালু রয়েছে। টিকার মাধ্যমে ক্যানসারের ঝুঁকিও অনেক কমিয়ে ফেলেছে পশ্চিমের নানা দেশ। দেরিতে হলেও এখন আমাদের দেশেও এইচপিভি টিকা পাওয়া যায়। দেশীয় সংস্থার টিকাও খুব শিগগির বাজারে চলে আসবে। সংক্রমণের বিপদ এড়াতে টিকাটি নিয়ে নেওয়া ভালো।’

এইচপিভি চিনতে কী কী টেস্ট
ক্যানসার প্রতিরোধে এইচপিভির একটি গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট হল প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট। প্যাপ স্মিয়ারে মহিলাদের সার্ভিক্স থেকে কিছু কোশ সংগ্রহ করে টেস্ট করা হয়। কোশগুলির মধ্যে প্রিক্যানসারাস (ক্যানসার পূর্ববর্তী) কোনও বদল দেখা যাচ্ছে কি না তা দেখা হয়।’ পাশাপাশি সুজাতার কথায়, ‘টেস্ট ২৫ বছর বয়স থেকে ৬৫ বছর বয়সের পর্যন্ত পাঁচ বছর অন্তর করালেই যথেষ্ট। যদি শরীরে সংক্রমণ দেখা দেয়, তাহলে নিয়মিত মনিটরিং অর্থাৎ ডাক্তার দেখিয়ে টেস্ট করাতে হবে। প্রিক্যানসারাস বা ক্যানসারাস চেঞ্জ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করিয়ে নিতে হবে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে প্রাণহানির ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে ফেলা যায়।’
পাঠকদের প্রতি: প্রতিবেদনটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মতামতের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। এটি সমস্যাটি সম্পর্কে সাধারণ ধারণার উপর আলোকপাত করা মাত্র। ব্যক্তিবিশেষে প্রতিটি সমস্যার চিকিৎসা এবং নিরাময়ের পদ্ধতি পৃথক। তাই যে কোনও সমস্যায় শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের কথায় ভরসা না রেখে, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকের বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।